সুমন রহমান : মৃদু আলোর আভা
শেখ শাহনওয়াজ : বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে, আমি যখন ঢাকাবাসী হই – তখনকার কথা বলছি। ঢাকায় তখন সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের তিনটি প্রধান কেন্দ্র ছিল। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার প্রাণকেন্দ্র অবজারভার হাউজ থেকে বেরুতো ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভার, বাংলা দৈনিক পূর্বদেশ ও সিনেমাপত্রিকা সাপ্তাহিক চিত্রালী। হাটখোলা রোডে ইত্তেফাক ভবন থেকে দৈনিক ইত্তেফাক ছাড়াও ইংরেজি দৈনিক নিউ নেশন প্রকাশিত হতো। এরপরে তাদের প্রকাশনায় যুক্ত হয় সাপ্তাহিক রোববার। আর মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা ও ডি আই টি রোডের মোড়ে অবস্থিত প্রেসট্রাষ্ট ভবন থেকে বেরুতো দৈনিক বাংলা, ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস ও সাপ্তাহিক বিচিত্রা। কিশোর বাংলাও কিছুদিন বেরিয়েছিল এখান থেকে।
উপরে উল্লেখিত তিনটি ভবন ছাড়াও ঢাকায় তখন আরো পত্রিকা অফিস ছিল। যেমন : মতিঝিল থেকেই বেরুতো দৈনিক বাংলার বাণী। সাপ্তাহিক ‘সিনেমা’ প্রকাশিত হতো একই হাউজ থেকে।

আমার ঢাকায় অধ্যয়ন ও চাকুরী জীবনে বেশী যাতায়াত ছিল প্রেসট্রাষ্ট ভবনে। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করতেন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী মাহফুজউল্লাহ ও চন্দন সরকার। আরেক সহপাঠী খালেদ খালেদুর রহমান তখন সাব-এডিটর হিসেবে কাজ করতেন দৈনিক বাংলায়। খালেদ প্রয়াত কবি ও দৈনিক বাংলার একসময়ের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হাসান হাফিজুর রহমানের ছোটভাই?
খালেদের খোঁজে মাঝেমধ্যে দোলতায় অবস্থিত দৈনিক বাংলার সংবাদ ডেস্কে ঢুঁ মারতাম। এখানে অনেক রিপোর্টার, সাবএডিটরকে আমি চিনতাম। শ্রদ্ধার সঙ্গে আমি এখানে স্মরণ করছি, সদ্যপ্রয়াত আমার বড়ভাইতুল্য আব্দুল হালিমকে। দৈনিক বাংলার সংবাদ ডেস্কে কমবেশি আমাদের বয়সী আরেকজনকে প্রায়শই দেখেছি।
তখনকার তরুণ এবং এখনকার পরিণত বয়সের সেই মানুষটির দেখা পাই আবার পঁচিশ বা তিরিশ বছর পরে এই টরন্টো শহরে। বেশ কয়েক বছর আগে, তখন টরন্টো থেকে সাপ্তাহিক বাংলা রিপোর্টার প্রকাশের উদ্যোগ চলছিল। একদিন সেখানে হাজির হই। অনেক বছর আগে দেখা সেই মানুষটির সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যায়? নাম জানা হয় – সুমন রহমান। তিনি আমাকে মৃদু হেসে অভ্যর্থনা জানান তাঁর সম্পাদনায় সুদৃশ্য ও সুখপাঠ্য বাংলা রিপোর্টার কার্যালয়ে। এর বছর দুই পরে সুমন রহমান টেলিভিশনের কাজ নিয়ে অন্যত্র চলে যান। আর অল্পদিনের মধ্যেই এই পত্রিকাটাও বন্ধ হয়ে যায়!
বাঙালিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সুমন রহমানের সঙ্গে প্রায়ই আমার দেখা ও সৌজন্য বিনিময় হয়। তাঁর মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া পাই? বন্ধুদের মাধ্যমে তাঁর নিউমার্কেটের বাসায় বইভাণ্ডারের খবর পাই। একটু আধটু পড়ার অভ্যাসের কারণে সেইসব বই দেখতে আমার লোভ হয়। সে আশাও একদিন পূর্ণ হবে, মনে হয়।
মাত্র কয়েকদিন আগে আমার লেখা একমাত্র বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে কবিবন্ধু দেলওয়ার এলাহীর আমন্ত্রণে সুমন রহমান সস্ত্রীক উপস্থিত হয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে আমার দেওয়া বইয়ে তাৎক্ষণিক চোখ বুলিয়ে এবং তারউপর আলোচনা করতে গিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের অস্পষ্টতা ধরিয়ে দিয়ে আমাকে তিনি কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন। প্রকাশনা অনুষ্ঠান পরবর্তী ছোট্ট একটি লেখায় সুমন রহমান আমার লেখা ও আমার সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাবও প্রকাশ করেছেন।
সুমন রহমান কথা বলেন কম; কিন্তু তার উপস্থিতি যে কোন পরিবেশকে সমৃদ্ধ করে- আলোকিত করে। তাঁর জন্মদিনে আমার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা!

আজ শুধু এটুকুই থাক
দেলওয়ার এলাহী : তারপর, রফিক আজাদের উঠতেই তিনি শুরু করেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প। স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের অগোচরে কতজনকে অর্থসাহায্য করেন নীললোহিত! পাবনার স্কুক শিক্ষকের পুত্র শঙখ ঘোষও দেখিয়ে দেন লোকে জানা মাতালের বুকে তোলপাড় করা ঢেউ। কেউ দেখতে পায়না বলে লোকে তাদের বলে মাতাল।
ইল পাস্তিনো বা দ্য পোস্টম্যান ছবির ডাকপিয়নের কথা মনে করে টোকিওর পথে হেঁটে হেঁটে চোখের জলে ভেসে যাওয়া গল্পটি আমি শুনি? শুনি মুরগী জবাই হয়েছে? উঠোনে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর মুরগীর ছটফটানি দেখে দরজার খিল লাগিয়ে কান্নার গল্প।
গল্প করতে করতে সহসা কান্নার দলাপাকিয়ে ওঠা মুহূর্তে তিনি থেমে যান। নীরবতার প্রসাধনীতে চোখের অশ্রু লুকিয়ে সুমন ভাইয়ের সরল সহজ শিশুরূপটি কতবার আমি দেখেছি!

জগতের সকল দর্শনশাস্ত্রের বই পড়ে কী হবে! নানান ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পাঠ করে কী হবে বা হয় জানি না। তবে, আমি এটুকু জানি, সুমন ভাইয়ের সান্নিধ্য আমার জন্য স্বস্তিকর শুধুই নয়, দারুণ আনন্দময়, মায়াময় ও হাস্যরসাত্মক।
সুমন ভাইয়ের মতো এতো গভীর ও সু² সংবেদনশীল মানুষ আমি কম দেখেছি। কোন অবস্থাতেই তিনি মানুষকে একটি তিক্ত বর্ণ বলতেও অপারগ। এরকম মানুষ আমাদের চারপাশে খুব বেশী নেই বলে, স্বাভাবিক আচরণবিধিতে আমরা বুঝতে পারি না, তাদের আনন্দ-বেদনার পারদ উঠানামার উষ্ণতার মাত্রা! কিন্তু সুমন রহমান সেই মানুষদের অনন্যসাধারণ একজন, যিনি অন্তত ক্ষোভ দুঃখ কষ্ট রাগ অভিমানকে দূরে সরিয়ে আনন্দের আবাহনে আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যান।
আমার সত্যি আশ্চর্য লাগে যে, সুমন রহমান না হয়, এরকমই মানুষ : মায়াময়, হাস্যরসাত্মক, জ্ঞানপিপাসু, বইপোকা, দয়ালু, নিম্নকণ্ঠ। কিন্তু প্রকৃতি যে শফিনা বেগম বন্যা ভাবিকেও সুমন ভাইয়ের সঙ্গেই জীবনকে যাপন করতে লিখে দিয়েছেন, সেটা কে আর জানতো! অবাক হয়ে দেখি দুজন মানুষকে! মিষ্টভাষী এই দম্পতি তো ঘরসংসার নিয়ে তেমন উতলা নয়, তাদের গভীর আনন্দ পরস্পরকে সম্মান দেখানো। ভালোবাসায় মোড়ানো তাদের এই পরস্পরের সম্মান প্রদর্শন চোখে হয়তো দেখাও যায় কদাচিৎ, কিন্তু এই বুঝাপড়া বড়ই বিরল। যেখানে সম্মানের পাশে আছে স্বস্তি, বুদ্ধির পাশে আছে বিনয়, যাতনাকে দূরে সরিয়ে আছে যাপনের প্রশান্তি, সংসার যাপনের পাশে আছে সমতার সংযোগ! একেবারে নিক্তি দিয়েও মাপঝোঁক করে বুঝার উপায় নেই পরস্পরের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা প্রকাশের মাত্রার তারতম্য।

আমি সুমন ভাইকে দেখি আর অবাক হই, এই বুঝি শত সহস্র গ্রন্থ সংগ্রহ ও পাঠের ফলাফল, বিরক্তি, ক্ষোভ, বিব্রতবোধ, প্রবল উচ্ছ্বাসকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারে রেখে নিজের সহজ সরল স্বাভাবিক মানুষের মতো মানবিক থেকে মাটিতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকা! আর কেউ কেউ পারেন কি না জানি না, সুমন রহমান পারেন। আমি সুমন ভাইকে অনেক ভালোবাসি!
সুমন রহমান: একজন পুস্তক পিপাসুর গল্প
এস. এম. আব্রাহাম লিংকন : প্রযুক্তির সুবিধা এখানেই- একজন মানুষের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলেও আপনার সাথে তাঁর সখ্যতা হতে পারে। ঘনিষ্ঠতা হতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সাথে আপনার দেখা সাক্ষাৎ থাকতেই হবে এমন ধারণাকে সেকেলে প্রমান করে দিয়েছে প্রযুক্তি। চিরন্তন বন্ধুত্বের জন্য বেঁচে থাকাও জরুরী নয়। আবার একজন মানুষ মৃত্যুর পরও কারো কারো বন্ধু হতে পারেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রেম বিরহে, নজরুল যেমন অনাচার-বিদ্রোহে, সূকান্ত যেমন সাম্যের লড়াইয়ে, জীবনান্দ দাশ যেমন প্রেম প্রকৃতির পঙতি আর উচ্চারণে আমাদের পরম বন্ধু, অতি আপনজন। তাঁদের দেহের বিলোপ হয়েছে কিন্তু আমাদের সাথে দিব্যি বসবাস করছেন। নিত্য তাঁরা উচ্চারিত হন আমাদের জীবনে।
দূরত্ব ও বাস্তবতার কারণে বেঁচে থাকা অনেক মানুষের সাথে আমার দেখা হয়নি। দেখা না হলেও তাঁদের অনেকেই আমার পরিচিত ও আপনজন। এরকম অনেক মানুষ আছেন যাঁদের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই। তাঁরা আমাদের প্রচলিত অর্থে আত্মীয়ও নন। কিন্তু তাঁরা আমার আপনজন। নিজের মানুষ। এরকম একজন মানুষ কানাডা প্রবাসী বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব জনাব সুমন রহমান। যিনি বাঙালি সংস্কৃতি ধারণ করে বিকশিত হওয়া বিশ্বজনিন মানুষ। দেশান্তরি হলেও যাঁর হৃদয় থেকে বাংলাদেশ নির্বাসিত হয়নি।

জগতে রয়েছে হরেক রকম মানুষ। যাঁদের হরেক রকম নেশা। হরেক রকম পেশা। হরেক রকম কর্ম। এরকম কিছু মানুষ আছেন যাঁরা এই হরেকের ভিতরে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন নি। তাঁরা অন্যদের প্রভাবে ফিকে হয়ে যান নি বরং উজ্জ্বল আছেন। এরকম এক উজ্জ্বল মানুষ সুমন রহমান।
হরেকের ভিতরে বসবাস করা সুমন রহমান যাঁকে আমি দেখিনি। কখনো কথাও বলিনি। অবশ্য নিকট অতীতে দেখা হওয়ার সুযোগ ছিলো কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। তিনি যে শহরে বসবাস করেন সেই টরেন্টো শহরেই মাসখানেক বসবাসের বিরল সুযোগ হয়েছিলো আমার। তখন তাঁর ঠিকানা অজ্ঞাত ছিল আমার কাছে। সে শহর ত্যাগের পর জেনেছি তিনি অন্টারিওতে থাকেন। তাজুল মোহাম্মদ ভায়ের কাছ থেকে ঠিকানা জানার পর দেখা না হওয়ার সে আফসোস থেকে গেছে। যদি আবার কখনো টরেন্টো শহরে যাবার সুযোগ ঘটে নিশ্চয়ই তাঁরসাথে দেখা হবে। সবচেয়ে বড়কথা ব্যক্তি সুমন রহমানের সাথে দেখা হওয়ার চেয়ে তাঁর সৃষ্টি ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারটি দেখবার আগ্রহই আমার কাছে বেশি। যেখানে অজস্র শ্রম আর ব্যয়ে সংগৃহিত পুস্তকমালায় তাঁর স্পর্শ আর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার বসবাস আছে। বিষ্ময়কর বিষয় হলো তাঁর সংগৃহিত হাজারো পুস্তকে পুস্তক লেখকের অটোগ্রাফ রয়েছে। যা অবাক হবার মতন ও বিরল ঘটনা। এতো বিপুল সংখ্যক লেখকের অটোগ্রাফ সম্বলিত পুস্তক সংগ্রহ ভাবাই যায় না। আমার দৃষ্টিতে তিনি জ্ঞান অন্বেষনের নেশায় বা সখের বশে তাঁর গড়ে তোলা গ্রন্থাগারের মাধ্যমে দু’টো ঘটনা ঘটিয়েছেন- যার একটি বিরল বিরল সব পুস্তক সংগ্রহ, অন্যটি বিপুল সংখ্যক পুস্তকে লেখকের প্রদত্ত অটোগ্রাফ।
মানুষ চিরদিন বাঁচবে না এটাই প্রকৃতি ও নিয়তি। একজন লেখকের দেহগত অবসান প্রকৃতির নিয়মে হয় ও হবে। দেহের অবসান হলেও লেখকের লিখিত পুস্তক রয়ে যাবে পাঠকের কাছে অনেক দিন। প্রকাশিত পুস্তকের গায়ে লেখকের নাম লেখা থাকলেও সব পুস্তকে লেখকের তাজা স্বাক্ষর বা অটোগ্রাফ থাকে না। ক্রেতা বা পাঠকের অনুরোধে দু’একটি পুস্তকে লেখক অটোগ্রাফ দিয়ে থাকেন। যে অটোগ্রাফে লেখক পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুভ‚তি বা প্রত্যাশা দু’চার শব্দে লিখিতরুপে প্রকাশ করেন। পাঠকের জন্য সেটি আনন্দের প্রাপ্তি। একইসাথে এটি এক বিরল সংগ্রহ বটে। অটোগ্রাফ দেয়া লেখকদের অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন। দেহান্তরিত লেখকদের সেই স্বাক্ষর আজ স্মারক হয়েছে। লেখকদের স্বাক্ষরগুলো আজ অমূল্য হয়েছে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে জনাব সুমন রহমানের সংগ্রহকে দু’টি পৃথক অলংকারে অভিধা দেয়া যায় । যার একটি ‘গ্রন্থ জাদুঘর’ অন্যটি ‘অটোগ্রাফ মিউজিয়াম’ নামে। কিংবা একত্রে ‘গ্রন্থ জাদুঘর ও অটোগ্রাফ মিউজিয়াম’ বললেও অত্যুক্তি হবে না।
আমি নিজে একটি জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা। তিন দশকের বেশি সময় ধরে স্মারক সংগ্রহ করি। একটি জাদুঘরে সংগৃহিত আর্টিকেলের মধ্যে পুস্তকসহ নানাবিধ স্মারক থাকে। প্রতিটি স্মারক সংগ্রহের পিছনে একটি করে গল্প আছে। স্মারক সংগ্রহ করতে শ্রম দিতে হয়েছে। ব্যয় করতে হয়েছে সময় ও অর্থ। এটি যারা করেন না তাঁদের পক্ষে এ কষ্ট অনুভব করা ভীষন কঠিন।

যতদূর জেনেছি-পুস্তক সংগ্রাহক সুমন রহমান অন্য অনেক অভিবাসীদের মতন- বউ, কড়ি আর গহণা নিয়ে দেশান্তরি হননি। তিনি যেখানেই গেছেন জ্ঞান অন্বেষনে পুস্তক কিনেছেন। পুস্তক পড়তে একটি কপি কিনলেই হয়। সেখানে তিনি চেষ্টা করেছেন একাধিক কপি সংগ্রহ করতে। দেশ-বিদেশে তিনি যেখানেই থেকেছেন তাঁর সাথে পুস্তকালয়ও বসবাস করেছে একইসাথে। এ যেন মোঘল সম্রাট হুমায়ুনের মতন যুদ্ধক্ষেত্রেও সঙ্গে নিয়ে গেছেন পুস্তকবাহী উট।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চারণ গবেষক বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত তাজুল মোহাম্মদ ভায়ের কাছ থেকে শুনেছি- জনাব সুমন রহমান জাপান ছেড়ে যখন কানাডায় আসেন তখন তিনি সাথে করে ৪৫ বড় কার্টন পুস্তক এনেছিলেন। বলা যায় আস্ত একটা পুস্তক জাদুঘর সঙ্গে এনেছেন। যাঁরা বিদেশবিভ‚ঁইয়ে থাাকেন তারা জানেন একটি চিঠি কুরিয়ার করতে কি পরিমাণ ব্যয় হয়। সেখানে ৪৫ কার্টন পুস্তক প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে নিয়ে আসতে কি পরিমাণ ব্যয় হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। সেটির অংক যে আঁতকে ওঠার মতন তা বলাইবাহুল্য। এতদসংক্রান্তে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে- ২০২১ সালের কথা, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজ ও স্নেহভাজন কুড়িগ্রামের সন্তান আতিক হাসান উত্তরবঙ্গ জাদুঘরের জন্য একটি হাল্কা প্রজেক্টর মেশিন বোস্টন থেকে নিউইয়র্কে এনেছিলেন আমার হাতে দিতে। যেটি বাংলাদেশে পাঠাতে প্রায় অর্ধ সহস্র মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে তাঁকে। যাঁরা বৈষ্যয়িক তাদের অনেকেই বলবেন-জনাব সুমন রহমানের এটি অহেতুক ব্যয়। কারণ জাপান থেকে ৪৫ কার্টন বই আনতে যে ব্যয় হয়েছে সে পরিমাণ পরিবহণ ব্যয় দিয়েই স্থাপনাসহ একটি ছোট্ট লাইব্রেরী গড়ে তোলা যেতো। হয়তো যেতো, কিন্তু তাতে কি দুর্লভ অটোগ্রাফ সম্বলিত পুস্তকগুলো পাওয়া যেতো? পাওয়া যেতো কি রেয়ার কালেকশনের সেই পুস্তকগুলো? অনেক দূর্লভ বই রয়েছে যার হার্ডকপি পয়সা দিলেও এখন আর পাওয়া যাবে না।
আমি মনে করি সুমন রহমানের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের বইগুলো তাঁর একক অর্থ ও শ্রমে অর্জিত হলেও এখন এটি সাংস্কৃতিক সম্পদ। সাংস্কৃতিক সম্পদ ও ঐতিহ্য হওয়ায় সেগুলোর ওপর জনস্বার্থমূলক অধিকার তৈরি হয়েছে। যাতে আপনার- আমার সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ঐতিহ্য ও পুরাকৃতি কারো ব্যক্তিগত দখলে থাকলেও তাতে নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। সুমন রহমানের পুস্তকগুলোর প্রাসঙ্গিকতা সে কারণে বিশ্বজনিন। হয়তো এক সময় বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে চিহ্নিতও হতে পারে।

আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সুমন রহমান সে বিশ্বদ্যিালয়েরই আমার অগ্রজ। যে কারণে আমার ভালো লাগা অন্যদের চেয়ে একটু বেশি। আমাদের মতিহারের অগ্রজ যা সৃষ্টি করেছেন তা আমাকে আন্দোলিত করেছে। গৌরাবন্বিত করেছে। আজকে তাঁর নামের সাথে সাথে বাংলাদেশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরবঙ্গ এ জনপদগুলোর নামও উচ্চারিত হয়। তাঁর জন্মদিন পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পনের দিনে। আমাদের বিজয়ের ১৬ ডিসেম্বর। নিশ্চয়ই এটি আরোপিত নয়, প্রাকৃত। সুমন রহমানের জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা ও প্রণতি।
পুস্তকপাগল সুমন রহমান পুস্তকের পিছনে ব্যয়িত জীবনের জন্য এক অনন্য উদহারণ। প্রায় আট দশক আগে সৈয়দ মুজতুবা আলী অনাগত ভবিষ্যতের সুমন রহমানের মতন মানুষদের দেখতে পেয়েছিলেন বলেই হয়তো তাঁর পঞ্চতন্ত্র প্রবন্ধ গ্রন্থের ‘বই কেনা’ প্রবন্ধে লিখতে পেরেছিলেন- বই কিনে কেউ তো কখনো দেউলিয়া হয় নি।
এ ব্রাত্যজনের আকুতি আছে তাঁর গ্রন্থ জাদুঘর ও অটোগ্রাফ মিউজিয়াম পরিভ্রমণের। একইসাথে প্রত্যাশাও আছে তাঁর একাধিক সংগৃহিত পুস্তক থেকে প্রয়াত কিছু লেখকের অটোগ্রাফকৃত পুস্তক উত্তরবঙ্গ জাদুঘরের জন্য স্মারক হিসেবে পাবার।
পাঠকদেরকেও অনুরোধ করি-আসুন বাঙালি কৃতিপুরুষ সুমন রহমানের কানাডায় গড়ে তোলা গ্রন্থাগারটি পরিভ্রমণের। আসুন নতুন প্রজন্মকে টেনে নিয়ে যাই সেখানে শেকড়ের সন্ধানে। দেখুক বিশ্ব আমরাও পারি।
লেখক: একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরষ্কারপ্রাপ্ত।

বই সুমন ভাই
আকতার হোসেন : সুমন রহমান হলেন এমন একজন মানুষ, যার আছে ‘মলাট মোড়ানো হাসি’। মলাট দেখে যেমন বই সম্পর্কে ধারণা করা যায় না, সুমন রহমানের হাসি দেখেও আন্দাজ করা কঠিন তিনি আলোচ্য বিষয়বস্তুকে সমর্থন দিচ্ছেন, না কি বিপক্ষের সমর্থক। ধরুন, সুমন ভাইকে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট কোনো প্রশ্ন করা হলো, কিংবা ধর্ম নিয়ে কিছু। তাঁর কাছে সাজানো-গোছানো উত্তর থাকা সত্তে¡ও ঠোঁট চেপে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে কথা শুনে যাবেন, অথচ কিছুই বলবেন না। কথার মধ্যে বাম হাত দেওয়া, সেটা তিনি কখনো করেন না। উন্নত মাত্রায় অবস্থিত তাঁর লিসেনিং স্কিল। সে কারণেই হয়তো তিনি টেলিভিশন উপস্থাপনায় সাফল্য এবং জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। অনেক সময় দেখেছি, কেউ হয়তো বকবক করে যাচ্ছে, অথচ সেই ব্যক্তি বুঝতেই পারছে না যে সুমন রহমান সেই ব্যক্তিটির মতামতের পক্ষে, না বিপক্ষে।
টিকটক কিংবা রিল দেখা জ্ঞান নিয়ে যারা তাঁর সঙ্গে কথা বলেন, তাদের জন্য একটি সাবধানবাণী শোনাচ্ছি। যদি কখনো এমন হয় যে আপনার কথা শুনে সুমন ভাই প্রত্যুত্তর না দিয়ে শুধু ‘মলাট-চাপা হাসি’ দিয়ে যাচ্ছেন, তবে কিন্তু আপনি গেছেন। আপনাকে ধরে নিতে হবে যে, তিনি আপনার জ্ঞানের মাপকাঠি ধরে ফেলেছেন। এই কথাগুলো শুধু তাদের জন্য প্রযোজ্য, যারা সুমন রহমানের কাছের লোক নন। আপনজনের কাছে তিনি কিন্তু ‘প্রফুল্ল লণ্ঠন’ সুমন ভাই। তিনি হাসেন এবং অন্যকেও অনেক হাসান।
আমি শুনেছি, বিভিন্ন সময়ে লোকজন তাঁকে বিভিন্ন নামে ডাকত। যেমন এটিএন সুমন ভাই, রিপোর্টার সুমন ভাই ইত্যাদি। তবে হাস্যরসিকতা এবং বিজ্ঞ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মতাদর্শের কারণে তাঁকে অনেক দিন থেকেই আমি ‘বই সুমন ভাই’ নামে ডাকতে শুরু করেছি। সুমন ভাইয়ের বাড়িটাকে যদি একটি জাহাজ বলা হয় (আকৃতির কারণে নয়), তবে সেই জাহাজ ভেসে আছে বইয়ের ওপর। যাদের ভাগ্য হয়েছে সুমন ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার, তারা দেখে এসেছেন যে ওনার বেজমেন্টে যে পরিমাণ বই আছে, তা অনেক ছোটখাটো লাইব্রেরিতেও নেই। কথা হলো বই কি ফুলের বাগান যে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে হবে? মোটেও তা নয়। যার ঘরে বই থাকে, তিনি বই পড়তে ভালোবাসেন, এটাই ধরে নেওয়া হয়। সুমন ভাইও বই কিনে শুধু সাজিয়ে রাখেন না; সেগুলো থেকে রশ্মি নিয়ে চিন্তাশক্তি উজ্জ্বল করে রেখেছেন। এটা তাঁর কথা ও বক্তব্য শুনলেই বুঝতে পারা যায়।
আজ সুমন ভাইয়ের জন্মদিন পালন করা হচ্ছে। তাঁকে জানাচ্ছি প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন, বই সুমন ভাই।

প্রত্যাবর্তন নয় গভীর আলিঙ্গন
(সুমন রহমান শ্রদ্ধাষ্পদেষু)
সাহিদুল আলম টুকু
প্রথম সূর্যোদয়ের দেশে থেকে
সূর্যের আলো ছড়িয়ে দিতে দিতে
আপনি টরন্টোয়।
একরাশ বন্ধুদের আড্ডা
রিপোর্টার-এ
অতীত দিনের স্মৃতির মোড়ক থেকে
আসন গ্রহণ করেন
আব্দুল গাফফার চৌধুরী, শামসুর রাহমান,
শহীদ কাদরী, বেলাল চৌধুরী,
রফিক আজাদ, রবিউল হুসাইন
আরো কত অগ্নিঝরা জন।
ইকবাল হাসান, দেলওয়ার এলাহী
অটোয়া থেকে লুৎফর রহমান রিটন
আহা!
সেইসব অমলিন আড্ডা
আলিঙ্গন রসের ফোয়ারা!
রিপোর্টার থেকে এটিএন
টরন্টো থেকে অনতিদূর নিউমার্কেট
প্রচণ্ড আলোর ফুল্লরী ছেড়ে নিভু নিভু
নিয়নের পথ
গভীর রাত-মধ্যরাত আর ভোরের মাঝে
আপনার বাড়িতে
কারা যেন কড়া নাড়ে, বেল বাজায়
‘অবনী বাড়ি আছো?’
আপনি তখন
বইয়ের এক শেলফ থেকে আরেক
শেলফে
রবীন্দ্রনাথ, কাম্যু, মার্কেজ অথবা
সিলভিয়া প্লাথ-এ মুখ-কান-নাক ডুবিয়ে
তাদের স্পর্শ ঘ্রাণে মাতোয়ারা।
বন্ধুদ্বয় দেলওয়ার-টুকু
পুনর্বার কড়া না নেড়ে বেল না বাজিয়েই
রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে ফিরে যায়
প্রত্যাবর্তন নয়,
আগামীদিনের প্রগাঢ় আলিঙ্গনের প্রত্যাশায়!
সুমন রহমান : সুন্দর মনের জ্ঞান পিপাসু আর বই পাগল মানুষ এক
মনিস রফিক : একদিন এক ছুটির দিন দুপুরে হঠাৎ করেই কবি দেলওয়ার এলাহী আমাদের কয়েক জনকে নিয়ে ছুটলেন টরন্টো থেকে নিউমার্কেটের পথে। অনেক বেশী শান্ত আর ছিমছাম শহরের যে বাড়ীর সামনে আমাদের গাড়ীটা থেমেছিলো, সেটা ছিলো সুমন রহমানের বাড়ী। শহরটির মতই ছিমছাম আর গোছানো বাড়ীটাতে ঢুকেই মনে হলো এ এক চমৎকার মননশীল মানুষের বাড়ী। আমরা যখন পৌঁছেছিলাম, তার কয়েক ঘন্টা আগেই যে কোন বাড়ীর দুপুরের খাওয়া শেষ হয়ে যাবার কথা। তবে আমাদের কয়েকজনের টিম হর্টনের কফি আর ডোনাট জাতীয় খাবার ছাড়া আর কিছুই খাওয়া হয় নি।
সুমন রহমানের বাড়ীতে যাওয়ার পর ভাবী আর সুমন ভাইয়ের আতিথিয়তায় মুগ্ধ থেকে মুগ্ধতর হতে থাকলাম। সেই সময়ই শুরু হয়ে গেলো এক মহাভোজের আয়োজন। চমৎকার সুস্বাদু খাবারের সাথে আমাদেরকে সুমন দম্পতির মুহূর্তেই আপন করে নিলেন। অথচ তাদের সাথে শুধু কয়েকবার ড্যানফোর্থ এলাকায় সামান্য কথা হয়েছে আমার।

সুমন রহমানের বাড়ীর সবচেয়ে অসাধারণ ব্যাপারটা অপেক্ষা করছিলো আমাদের খাবার শেষ হবার পর। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো বেইজমেন্ট এ। বিশাল বেইজমেন্ট এ গিয়ে একেবারে অবাক হয়ে গেলাম তাঁর নিজস্ব লাইব্রেরী দেখে। কোন মানুষের সংগ্রহে যে এত বেশী এবং মহামূল্যাবান বই থাকতে পারে সেটা সাধারণত কল্পনা করা যায় না। এমন সংগ্রহ হয়তো কারো থাকতেই পারে, তবে সেটা বেশ কিছু লাখের মধ্যে দু’এক জনের। সুমন রহমানের মত এমন বইয়ের সংগ্রহ আমি দেখেছি আমার জন্ম শহর রাজশাহীতে, আমার গুরুজন ড তসিকুল ইসলাম রাজার বাড়ীতে।
সুমন রহমান দেশ বিদেশে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে সাংবাদিকতা করেছেন দীর্ঘদিন। আমাদের পরিচয়টা একটু গভীর হতে থাকলে আমি জানতে পারলাম, আজীবন জ্ঞান পিপাসু সুমন রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগের অগ্রজ।
সেই সুমন রহমানের বাড়ীর সেই হাজার হাজার বইয়ের সংগ্রহ দেখে আমি এতই বিস্মিত হয়েছিলেম যে, পরের বছর যখন আমি বাংলাদেশে গিয়ে ড. তসিকুল ইসলাম রাজার সাথে দেখা করতে গেলাম। তখন তাঁর বিশাল গ্রন্থশালায় বসে তাঁকে বলেই ফেললাম, স্যার আমি ভাবতাম, আমার দেখা মতে আপনার সংগ্রহেই সবচেয়ে বেশী বই আছে। কিন্তু আমি টরন্টোর পাশের শহরে সুমন রহমান নামে একজনের সংগ্রহে যে গ্রন্থ দেখেছি, তাতে আমার ধারণা একেবারে সঠিক বলে আর মনে করছি না। তারপর রাজা স্যারের সাথে সুমন রহমানকে নিয়ে অনেক কথা হতে থাকে, আমাদের কথার মাঝে হঠাৎ তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ও তুমি আমাদের সুমনের কথা বলছো? সেতো আমার খুবই কাছের বন্ধু। ক্যাম্পাস জীবনে আর সাহিত্য নিয়ে আমাদের নিযুত নিযুত স্মৃতি। সুমন পড়তো ইংরেজিতে আর আমি বাংলায়। আমরা ছিলাম অভিন্ন হৃদয়ের দুই পুরুষ। সুমন জাপানে বেশ কয়েক বছর থাকার পর কানাডায় গেছে, কিন্তু কয়েক যুগ দেখাও হয় নি, কথাও হয় নি।
সেই সুমন রহমানের সাথে রাজা স্যারের যোগাযোগ করিয়ে দেবার পর আমার প্রতি রাজা স্যারের যে কি এক উচ্ছ¡সিত কৃতজ্ঞতা! স্যার শুধু আমাকে বলেছিলেন, এত বছর পর এমন এক অসম্ভব সুন্দর বন্ধুর খোঁজ দিয়ে তুমি আমার জীবনী শক্তি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছো। তিনি আমাকে আরও জানিয়েছিলেন, এই পৃথিবীতে সুমন রহমানের মত সুন্দর মনের জ্ঞান পিপাসু আর বই পাগল মানুষ খুবই কম আছে।
বাংলাদেশের বিজয়ের দিনে এই সুন্দর মনের জ্ঞান পিপাসু আর বই পাগল অসাধারণ মানুষটার জন্মদিনে আমার অবিরল শুভেচ্ছা আর বিনম্র শ্রদ্ধা।
সুমন রহমান : নিরবচ্ছিন্ন গ্রন্থমগ্ন মানুষ
মৈত্রেয়ী দেবী : একজন সুমন রহমানকে নিয়ে লেখা মানে শুধু একজন লেখককে নিয়ে লেখা নয়, বরং একটি জীবনের ভেতরে গড়ে ওঠা পাঠ, চিন্তা ও মানবিকতার দীর্ঘ যাত্রাকে ছুঁয়ে দেখা। তিনি সেই মানুষদের একজন, যাদের পরিচয় কেবল পরিচয়পত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না- যাদের ঘর, কণ্ঠ, আচরণ আর নীরবতায়ও সাহিত্য বাস করে। বই তাঁর কাছে শৌখিনতার বস্তু নয়; বই তাঁর দৈনন্দিন জীবনের অংশ। পাঠের সাথে তাঁর সম্পর্ক গভীর, স্থির এবং নিরলস। তাঁর বইয়ের সংগ্রহ চোখে পড়ার মতো নয়, বরং মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। সারি সারি বই যেন কেবল তাকজোড়া স্মৃতি নয়- সেগুলো ভাবনার সহযাত্রী, সময়ের সাক্ষী। সেই বইঘরে দাঁড়িয়ে মনে হয়, এটি কোনো ঘর নয়- এ এক চিন্তার আশ্রয়। সাহিত্যচর্চায় তিনি শব্দের জাঁকজমক খোঁজেন না। বরং সহজ ভাষায় কঠিন কথা বলার যে সাহস ও দক্ষতা, তা তাঁর লেখার বড় শক্তি। তাঁর কণ্ঠে যেমন আছে দরাজ উচ্চারণ, লেখাতেও তেমনি আছে স্পষ্টতা ও ভারসাম্য। পাঠককে তিনি আকৃষ্ট করেন জোর করে নয়- আত্মস্থ করে।
মানুষ হিসেবেও সুমন রহমান ভীষণ রকমের আন্তরিক। আতিথেয়তায় তাঁর ঘরে প্রবেশ করলে প্রথমবারের অতিথিও আপন হয়ে যায়। পরিবার, সম্পর্ক ও বন্ধনে তাঁর উপস্থিতি উষ্ণ এবং নির্ভরযোগ্য। তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের সৌহার্দ্য যেন সেই মানুষটিরই নীরব প্রতিফলন। একদিন ভাঁইফোঁটার ফোঁটা কপালে নিয়ে তিনি শুধু লেখক বা মিডিয়া ব্যক্তিত্ব রইলেন না- হয়ে উঠলেন একজন বোনপ্রেমী ভাই। সেই মুহূর্তে সাহিত্য আর সম্পর্ক মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।

সুমন রহমান এমন একজন মানুষ, যাঁর জীবনযাপন নিজেই একটি চলমান গদ্য। সেখানে আছে বই, মানুষ, ভালোবাসা ও দায়িত্বের সমন্বয়। তিনি লিখে যান, পড়ে যান- আর নিঃশব্দে আমাদের মনে করিয়ে দেন, বইপ্রেম আসলে মানুষপ্রেমেরই আরেক নাম।
বইয়ের গন্ধে ঘুম আসে না
হিমাদ্রী রায় : শুধু জ্ঞান অর্জনের আধার নয়,আমাদের চিন্তার উন্নয়নের জন্য মহত্তম মাধ্যম হচ্ছে বই। বই শুধু মানুষের অজানার দ্বার খুলে জানার পরিসরকেই বিস্তৃত করে না বরং বাস্তব জীবনে এর প্রতিফলন ঘটিয়ে জীবনকে মহিমান্বিত করে। ‘মদ মাতালে মাতাল বলে আর মন মাতালে মাতাল করে’ একটি বই থেকে চুইয়ে পড়া রস মাতাল করতে পারে পাঠককে। আমার অভিবাসী জীবনে দেখার অভিজ্ঞতায়, জ্ঞানসমুদ্রে জ্ঞান কলস পূর্ণ করে পিপাসা নিবারণের ঠিকানা আমি আবিষ্কার করেছিলাম টরন্টোর অদূরে নিউমার্কেটে। বইয়ের সাথে এক অন্তরঙ্গ গৃহস্থালি, একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি যার সংগ্রহকার এবং কর্ণধার আমাদের সুমন রাহমান। আমাদের শ্রদ্ধার ভালোবাসার সুমন ভাই। কি নেই তার সংগ্রহে! তাক থেকে একটি বই নিয়ে তার অক্ষরে হাত বুলিয়ে স্পর্শ করা যায় সেই সব লেখক যাকে আপনি সন্ধান করছেন। আমার সৌভাগ্য সুমন ভাইয়ের আলয়ে আমার বই যাত্রাটা তীর্থ হয়ে উঠেছিলো; কারণ সে যাত্রায় ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী, কবি ইকবাল হাসান ও কবি দেলওয়ার এলাহী। আমার ভাবনা বদলের জন্য সুমন ভাইয়ের এই আতিথেয়তার প্রয়োজন ছিলো।
আমাদের আভিজাত্যের তালিকায় অল ইনক্লুসিভ ভ্যাকেশন, টেসলা, স্কাইভিউ কন্ডোর বাইরে পুরো বেইসমেন্টে পৃথিবীর বিখ্যাত সাহিত্য ও গবেষণার বইয়ের লাইব্রেরী আভিজাত্যের তালিকাটাকে আরও অভিজাত করে তুলে। সুমন ভাই যদি কোনদিন আপনার আত্মজীবনী লেখেন তবে এই নামটি যথার্থ হবে : বইয়ের গন্ধে ঘুম আসেনা। শুভ জন্মদিন সুমন ভাই।
সুমন রহমান : সুখস্মৃতির মুখ
নুসরাত জাহান চৌধুরী শাঁওলী : সুমন ভাই এর কথা বলতে গেলেই আমার চোখে ভাসে আমার বাবার হাসিমাখা প্রসন্ন মুখটি। আব্বু যেমন বই প্রেমিক ছিলেন, বই মেলা, বইয়ের গ্রন্থগার, পাঠাগার ছিল তাঁর অনেক পছন্দের জায়গা, ঠিক তেমনই একজন বইপ্রেমিক হলেন সুমন রহমান। উনার বাসায় যেবার গেলাম এতো এতো বইয়ের কালেকশান আর লাইব্রেরি দেখে বুঝতে পারছিলাম না, এটা উনার বাসা, না আসলেই পাবলিক লাইব্রেরি। জ্ঞানীগুণীদের এক টুকরো স্বর্গরাজ্য যেন..! স্বাভাবিক ভাবেই আমার বাবার অনেক অনেক পছন্দের একজন প্রিয় মানুষ তিনি। শুধু সুমন ভাই নয় সাথে আমাদের বন্যা ভাবীকেও আব্বু অনেক স্নেহ করতেন। দুইজনের পেশাগত মিলও ছিল। দুইজনেই সাংবাদিকতা করতেন এবং লেখালিখির জগতে বিচরণ অগাধ। পূর্ব পরিচিত থাকলেও ব্যক্তিগতভাবে পরিচিতিটা হয় এই টরন্টো শহরেই।

প্রিয় দেলওয়ার ভাই, প্রয়াত কবি ইকবাল হাসান চাচা, তাসলিমা চাচী, সালমা বাণী আপা, এবং সুমন ভাই ও বন্যা ভাবি, আমিন চাচা-চাচী, সৈয়দ ইকবাল চাচা, এরকম আব্বুর সব প্রিয় মানুষগুলোর আগমনে আমাদের বাসায়,বা অন্য কারোর ঘরোয়া আড্ডায় যে প্রাণ সঞ্চার হতো, যে আনন্দঘন মুহূর্ত তৈরী হতো, তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে অক্ষম। তাঁদের মজার মজার স্মৃতিচারণ, হাসির গমক, ঠাট্টা, গান কবিতা, মজার মজার খাওয়া দাওয়া ..কি যে আনন্দময় সেই স্মৃতি! ২০১৯-এ টরন্টোয় বাবাকে নাগরিক সম্বর্ধনা দেয়া হলো অনেক বড় করে। সেই সময় এই প্রিয় মানুষগুলোর ভ‚মিকা ছিল অতুলনীয় ও অপিরিসীম। আমরা কবি পরিবার এই সুবাদে আবারো আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আপনাদের সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে। ২০১৯ এ মন্ট্রিয়ালে দ্বিতীয় নাগরিক সম্বর্ধনায় বাবার সারথী ছিলেন এই সুমন দম্পতি। সাথে ছিলেন প্রিয় দেলওয়ার ভাই ও আম্মু। সেখানে কিছু ছবি ফেসবুকে দেখেই বুঝেছিলাম কি মজা উনারা করেছিলেন। তাছাড়াও আমাদের এই পাড়ায় সুমন ভাই ও ভাবি সেই নিউ মার্কেট থেকে যখনই আসতেন বাবার খোঁজ নিতেন। দেখা করতে আসতেন, একটু হলেও পাশে বসে আড্ডা মেরে যেতেন।
আমার বাবাকে নিয়ে অনেক বড় করে একটি আয়োজন করার ইচ্ছা এই মানুষ গুলো করেছিলেন। এমনকি আমার প্রয়াত চাচা বিশিষ্ট সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীকেও লন্ডন থেকে আনার চিন্তা তাঁদের ছিল। কিন্তু ইকবাল হাসান চাচা এবং পরবর্তীতে আব্বু নিজেই অসুস্থ হয়ে যাওয়াতে এই বড় উদ্যোগটি আর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। সুমন ভাই আমার সাথে দেখা হলে খুবই আক্ষেপের সাথে এই ব্যর্থতার কথা বলেন। আব্বুর দুঃসময়ের দিনে এই মানুষগুলো হাসপাতালেগুলোতে দেখা করতে গেলে বাবার চোখে ঝিলিক দিতো অন্যরকম এক সুখ। হয়তো অনেক সুখের স্মৃতিতে মনটা একটু হলেও আনন্দ পেতো। আব্বু চলে যাওয়ার পরেও টরেন্টোতে বড় একটি স্মরণসভা হয়। এবং এটিতেও সুমন ভাই ও ভাবি ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। প্রিয় সুমন ভাই, আপনি হচ্ছেন সেই প্রিয় মানুষদের একজন যাকে বাবা হৃদয়ের খুব কাছাকাছি রাখতেন। এই ভালোবাসার ঋণে আপনিও আমাকে ঋণী করে ফেলেছেন। কিছু কিছু ঋণ শোধ করতে নেই। ঠিক তেমনি …!
অনেক ভালো থাকবেন প্রিয় সুমন ভাই!

