হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
আমার জীবন যাপন ছিল কিছুটা রুটিনের বাইরে। অনেকটা এলোমেলো। তবে উচ্ছৃঙ্খল নয়। ফলে জীবনটাকে আমি মনের মতো সাজাতে পারিনি। জীবনে অর্জন করতে পারলাম না কোনোকিছুই। তাতে অবশ্যি আমার এলোমেলো চলার গতি থেমে যায়নি। আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না কখনও। বর্তমানটাকেই উপভোগ করেছি যতটা সম্ভব। ভবিষ্যৎ নিয়ে বিন্দু পরিমাণ ভাবলে বোধহয় আমার জীবনটা সাজানো বাগানের মতোই হতো। কারণ যেসব সুবিধা ও সুযোগ আমি পেয়েছিলাম, তা কাজে লাগাইনি।
একটা কল্পনা, একটা ‘ইউটোপিয়া’য় বিভোর থাকতাম আমি। আর তাতে মদদ যোগাত আমার পাঠ্যপুস্তক বর্হিভূত পাঠের মালমশলাগুলো। যাইহোক, আজ আমি শিকারের গল্প করব।
আমার এসএসসি পরীক্ষার আগে বা পরের দিনগুলোতে সেবা প্রকাশনীর বিখ্যাত শিকারি ক্যানেথ অ্যান্ডারসনের ‘জঙ্গল’ পড়েছিলাম। বইটি অ্যান্ডারসনের ‘This is the Jungle’-এর অনুবাদ ছিল। বইটি পড়ে দারুণভাবে প্রভাবিত হই এবং পরবর্তীতে শিকারের যাবতীয় বই সংগ্রহ করতে লাগলাম এবং পড়তে লাগলাম। সেবা প্রকাশনীর সেই ‘রুদ্রপ্রয়াগের চিতা’, ‘কুমায়ুনের মানুষখেকো’ ছাড়াও সংগ্রহ করলাম শিকার সম্পর্কিত সেবা’র প্রায় সব বই। এরমধ্যে জন হান্টারের ‘অনুসরণ’ ছিল অন্যতম। সংগ্রহ করলাম J. Butt-এর (Khan Shahib Jamshed Butt)-এর ‘Shiker.’ বেশ ক’বছর পর সংগ্রহ করলাম অ্যান্ডারসনের ‘The Tiger Roars’, ‘In a Jungle Long Ago’, ‘The Call of the Man Eater,’ ‘Nine Maneaters and One Rogue’, ‘Queer Things’, J.H. Patterson (Lt. Colonel John Henry Patterson)-এর ‘The Man-eaters of Tsavo’ (সাভোর মানুষখেকো, ১৯০৭)। এই বইটি পড়ার বহুবছর পর (২০০৯) প্যাটারসনের অভিজ্ঞতার আলোকে নির্মিত ‘The Ghost and the Darkness’ ছবিটি দেখলাম আমি আর আমার পুত্র শাহদিব।
আমার সংগ্রহে আরো আছে জিম করবেটের ‘Man Eaters of Kumaon,’ ‘Jungle Lore’, ‘The Temple Tiger’ ‘Gorilla Hunter’ প্রভৃতি। তবে করবেটের ‘My India,’ বইটি সংগ্রহ করতে পারিনি। সেটি সংগ্রহ করার ইচ্ছে আছে। Gorilla Hunter (by Fred G. Merfield with co-author Harry Miller)) বইটি আমি ক্যানেডায় এসে সংগ্রহ করেছি।
বিক্রমপুর হাউসে থাকাকালিন অ্যান্ডারসনের একটি বই থেকে অনুবাদ শুরু করলাম। সেসময় রমজান মাস চলছিল। ভোররাতে সাহরি খেয়ে আর ঘুমাতাম না। অনুবাদের কাজ করতাম। সেখান থেকে একটা এপিসোড (Novice of Manchi) অনুবাদ করে নাম দিলাম ‘মাঞ্চির ত্রাস’। তারপর সেটা পাঠিয়ে দিলাম কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছে। অল্পদিনেই উত্তর এসে গেল। তিনি দেখা করতে বলেছেন আমাকে। দেখা করলাম, আমার অনুবাদের প্রশংসা করলেন তিনি এবং আমাকে জানালেন যে, শিকারের (জিম করবেট আর ক্যানেথ অ্যান্ডারসনের) প্রায় সব অনুবাদই সম্পন্ন। রকিব হাসান সেকাজটি সম্পন্ন করে রেখেছেন। আমি যেন যেগুলো বাকি আছে, মানে কয়েকটি বই থেকে খুঁজে বার করে অনুবাদযোগ্য অন্য এপিসোডগুলো অনুবাদ করে ফেলি। তিনি আমাকে ৭% পারিশ্রমিকের প্রস্তাবনা করলেন। আমি রাজি হয়ে তারপর সেগুনবাগিচাতেই অফিসে বসেন এমন দু’জন লেখক শেখ আবদুল হাকিম (প্রয়াত) ও রকিব হাসানের সাথে কথা বললাম। তাঁদের সাথে কথা বলার পর আমি লেগে গেলাম কাজে। কিন্তু একটা বই হবার মতো যথেষ্ট এপিসোড খুঁজে পেলাম না। যেগুলো পেলাম তা আমার ভালো লাগল না। সুতরাং ক্ষ্যামা দিলাম।
আর একটা অতৃপ্তি মনের মধ্যে থেকেই গেল চিরতরে। পরে আমার অনুবাদকৃত ‘মাঞ্চির ত্রাস’ অধ্যায়টি কয়েক কিস্তিতে একটি স্বল্প প্রচারিত দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ছাপিয়ে ফেললাম। কারণ এটি ভালো কোনো পত্রিকায় কয়েক কিস্তিতে ছাপাবার মতো উল্লেখযোগ্য কোনো বিষয় ছিল না। বই হিসাবে সেবা প্রকাশনী থেকে বের হলে সেটা অন্যরকম ডাইমেনশন পেতে পারত। আমার অতৃপ্তিটা এতই প্রবল ছিল যে শিকার সম্পর্কে যে পড়াশোনা করেছি সেটা শেয়ার করতে অনেকের সাথেই শিকার বিষয়ে আলোচনা করতাম। মালয়েশিয়ায় আমি ট্রেইনিং করেছিলাম পরিবেশ বিষয়ে। সেখানে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বেলুম উপত্যকায় যাবার। সেখানের রেইনফরেস্টে আমাদের অভিযান চলে রাতব্যাপি। মায়াহরিণ আর টাপিরের বসবাসস্থল, অসংখ্য প্রাণী ও পোকামাকড় আর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুল (র্যাফেলশিয়া- এক ধরনের বড় ছত্রাক) প্রভৃতির প্রাপ্তিস্থান এই ভ্যালি। আমার এই অভিজ্ঞতার ওপর একটি লেখা তৈরি করে নাম দিলাম- ‘A Night in Belum Valley’. তারপর সেটা পাঠিয়ে দিলাম ডেইলি স্টার উইকএন্ড ম্যাগাজিনে। সেখানে আমার প্রকৃতি-প্রীতি, শিকার ও প্রাণী সম্পর্কিত আমার আগ্রহ ও পড়াশোনার কথা মন খুলে বললাম। ডেইলি স্টার ম্যাগাজিনে সেটা ছাপা হলো। মনে হলো, আমি আমার মনের কথাটা প্রকাশ করতে সক্ষম হলাম।
এখন তো আর শিকারের যুগ না। সুতরাং শিকারের নতুন কাহিনি আর সৃষ্টি হবে না। যা সৃষ্টি হয়েছে, সেসব এখন রূপকথার মতো। কিন্তু সেসব নিয়ে গবেষণা হতে পারে। বই হতে পারে, তাতে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রাণী সম্পর্কে জানতে পারবে। প্রাণিসংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষায় তারা অবদান রাখবে। সেই রুদ্রপ্রয়াগের চিতার কথাই ভাবুন। জিম করবেট যার পেছনে আটটি বছর ঘুরে বেড়িয়েছেন! কীভাবে সেই চিতাটি (চিতাবাঘ) সুদীর্ঘসময় ধরে ৫০০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে ‘কারফিউ’ জারি করে রেখেছিল! মিথ নয় কি! সেসময় শুধুুমাত্র ভারতবর্ষেই কী বিপুল পরিমাণ জীববৈচিত্র্য ছিল, আর ছিল কত হরেক রকমের পাখি আর প্রাণী!
আজ এ পর্যন্তই। অন্য একদিন শিকার সম্পর্কে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে রয়েছে।
© 2025 সর্বসত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি Develop By: Md Shovon Khan