সুমী রহমান : রিমা যখন কাঁদতে কাঁদতে এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল তখন আমার মনের ভিতর দাউ দাউ আগুন জ্বল ছিল। হা, রিমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসী আর সেজন্যই হঠাতই কাজী অফিস এ গিয়ে বিয়ে করি রিমাকে। কারণ আমি চাই না, যে ফিরে এসে দেখি ও অন্য ঘরে। তখন যুদ্ধের দামামা বাজছে। “এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার সময় তার”! যুদ্ধে যাব, কিন্তু রিমা? ওকে হারাতে তো পারব না আমার জীবন থেকে! তাই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেই কাউকে না জানিয়ে। এমন কি রিমাকেও বলিনি আমার উদ্দেশ্যর কথা। রিমা তখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে, আর আমি পাশ করে বেরিয়েছি মাত্র।
আমরা একই স্কুলে পড়তাম, একই আবাসিক এলাকায় থাকতাম। একসাথে হেঁটে স্কুলে যেতাম। সেই থেকে ওকে ‘আমার’ ভাবতে শুরু করেছি। ওর দুষ্টু চাহনি আর মিষ্টি হাসি আমাকে বুঝিয়ে দেয় ও শুধুই আমার। মা-বাবা সবাইকে অবাক করে রিমাকে ঘরে তুলে আনি। কিন্তু রাত পোহাবার আগেই সাজানো বাসর ঘরে থেকে পালিয়ে আসি। রিমার কপালে চুমু খেয়ে ওর বিছানার পাশে একটা চিঠি লিখে রাখি! জানি না ওর মনের ভিতর সেদিন কি উথাল পাতাল হয়েছিল। এক লাইনের চিঠিতে লেখা ছিল “যুদ্ধে গেলাম, তুমি ভালো থেকো”! মা’র সাথে থেকো!
শুনেছি রিমা খুব কেঁদেছিল, শুধু চুপ চাপ জানালা ধরে তাকিয়ে থাকতো “স্বামী তার কখন আসে, কখন আসে”। রিমার বাবা ওকে অনেক চেষ্টা করেও নিয়ে যেতে পারেনি আমাদের বাড়ি থেকে! যুদ্ধ ক্ষেত্রে শুধু রিমার ঘুমন্ত মুখটা মনে পড়তো। কি নিশ্চিন্তে পরম নির্ভরতায় আমার বুকে ঘুমিয়েছিল। বিবেকের দংশনে পুড়ে যেতে লাগলাম কেন ওকে বিবাহ বন্ধনে বন্দী করে রেখে এলাম! মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াবার স্বাধীনতা কেন হরণ করলাম! আমার মৃত্যুতে রিমা অকালে বিধবা হবে! না না এ অন্যায়, কেন এমন কাজটা করলাম!
আমি ওপারে যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছি। শুরু হলো অপারেশন, একটা পুরো টিমের ভার আমার উপর। যুদ্ধ করতে করতে মিলিটারিদের পিছু হটিয়ে যশোর থেকে ঢাকার দিকে যাচ্ছি। জয় আমাদের নিশ্চিত! মিলিটারীরা পালিয়ে যাচ্ছে ঢাকার দিকে, পালানো গাড়ী থেকে হঠাতই একটা গুলি এসে পরে আমার পায়ে, গল গল তাজা রক্ত! তারপর আর আমার মনে নেই। আমি হাসপাতালে, রিমা আমার মাথার কাছে। এই নয় মাসে চেহারা বিবর্ণ, আমার সেবায় চোখে ক্লান্তির ছাপ, মুখে তৃপ্তির হাসি। হঠাত উপলব্ধি করলাম আমার ডান পা’টা উঠাতে পারছি না। আমি চিৎকার দিয়ে বললাম, “কেটে ফেলেছে”? যে পা দিয়ে স্বাধীনতা আনলাম, মাঠে ঘটে প্রান্তরে দৌড়ঝাপ দিয়ে শত্রæর মোকাবেলা করলাম! সেই পা’টাই নেই! আমার কান্না দেখে রিমা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল। ‘যুদ্ধ তাহলে একেই বলে”! রিমা আমাকে হুইল চেয়ার ঠেলে নিয়ে গেল বাড়ীতে। ও একটা স্কুলে কাজ করে, আমার সবকিছু গুছিয়ে সকালের নাস্তা দিয়ে তারপর কাজে যায়, ফেরার সময় বাজার-সদয় নিয়ে আসে, রাতে খাবারের পর পরের দিনের রান্না করে রাখে। কোনো কমপ্লেইন নেই! আমি তার মুখের দিকে তাকাতে পারিনা। রিমার জন্য খুব কস্ট হয়! আমার জন্য এই ভোগান্তি! কি করতে পারি আমি? কি ই বা করার আছে আমার?
নাহ! আর নয়! ওকে মুক্তি দিতে হবে। রিমার সুন্দর জীবন পাবার অধিকার আছে। পঙ্গু স্বামীর সাথে দারিদ্র জীবন তার প্রাপ্য় নয়! এ বয়সে ও সঙ্গীর হাত ধরে যখন তখন যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবে। সনির্ভর একজন মানুষ, যার সাথে বাকি জীবন নিশ্চিন্তে কাটাতে পারবে। সন্তানের মা হবে, আমি তো তা দিতে পারব না। তবে কোন অধিকারে আমি ওকে ‘আমার’ করে রাখবো! প্রচন্ড এক অপরাধবোধ ঘনীভ‚ত হতে থাকলো। যে করে হোক মুক্ত আকাশে ওকে ছেড়ে দিতেই হবে। জানি ও চাইবে এই খাচা আকড়ে ধরে থাকতে। যুদ্ধের এই এই নয়টা মাস রিমা নিজের সাথে যুদ্ধ করেছে। মা’র সাথে থেকেছে আমার অপেক্ষায়।
সেদিন রিমা কাজ থেকে ক্লান্ত হয়ে বাড়ী ফিরতেই রিমাকে বললাম, ‘ঘরে পঙ্গু স্বামী রেখে বাইরে ফস্টি নষ্টি করো, ভেবেছ আমি কিছু জানি না! এক্ষুনি চলে যাও আমার বাড়ি থেকে। আর যেন কোনো দিন তোমার মুখ দেখতে না হয়! চরম আঘাত হানলাম। রিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। যাও, যাও বলছি, বলে দরজা লাগিয়ে দিলাম। দেখলাম ও কাঁদতে কাঁদতে গেট থেকে বের হয়ে গেল। জানি এ নাহলে কিছুতেই আমাকে ছেড়ে যাবে না। রিমা আমাকে অনেক ভালোবাসে, তাই ভেবে চিনতে এ রকম একটা মিথ্যা অপবাদ দিতে বাধ্য হলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিও রিমা! তুমি মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াও এই আমি চাই!
© 2025 সর্বসত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি Develop By: Md Shovon Khan