কানাডা, ০৯ জুলাই, ২০২৫, ,

বিজ্ঞাপন ☎ 416 693 2223
কলাম

এ যেন অজানা এক পথ

ইউসুফ কামাল : ১. 
হিথ্রো থেকে ওয়াশিংটন ড্যুলাসের উদ্দেশে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ৭৪৭ বোয়িং ছেড়ে দিলো তিন ঘন্টা বিরতির পর আবার এক লম্বা এক পথ পাড়ি দেওয়ার কল্পে। আটলান্টিক মহাসাগর (লন্ডন থেকে ওয়াশিংটন) আড়াআড়ি পাড়ি দেওয়ার জন্য বিমানের সময় লাগে দীর্ঘ সাড়ে সাত ঘন্টা। পুরোটাই সমুদ্রের উপর দিয়ে পাড়ি দিতে হয়। পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার ফুট উপর উড়ার কারণে নীচে মেঘ ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। যাত্রার শেষ দিকে উপকুলের কাছে আসার পর বিমানের উচ্চতা কিছুটা কমে আসে তখন ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে নীচের সমুদ্রে চলাচল রত দু’একটা মালবাহী সামুদ্রিক জাহাজ নজরে পড়তে পারে।

তাও আকৃতিতে ছোটই দেখা যায়। সারা সময়টা তখন মাথার মধ্যে শম্পা’র চেহারাই ভেসে বেড়াচ্ছিলো। বলতে গেলে ওর চেহারাটা অনেকটা আবছা হয়ে গিয়েছিলো দীর্ঘ দিন না দেখার কারণে। ইমিগ্রেশন এর লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখার পর চেহারাটা পূর্ণভাবে মনে পড়ে গেলো আমার। মনে হলো যেন দীর্ঘ দিন পর ফিরে এলো আমার কাছে। ‘বিদেশী’ লেখা কাউন্টারের লাইনে দাঁড়ানো দেখে বুঝেছিলাম ওর পাশপোর্টটা বিদেশী যে কোন দেশের হবে। তার মানে ও ভিন্ন কোন দেশের নাগরিক। লাইনে ওর দাঁড়ানোর ভংগিতে কেন জানি মনে হয়েছিল ও একাই ভ্রমণ করছে সাথে কেউ নেই। সেই সাবেক স্বল্পবাক শম্পার স্থলে এ যেন এক নব রুপের শম্পা, যাকে চিনে ওঠা সম্ভব না। চেহারার মধ্যে খুব বেশী একটা পরিবর্তন হয়নি, বয়সের ছাপ বোঝা যায় না প্রসাধনি ব্যবহারের কারণে। বয়সের কারণে স্বাস্থ্যের একটু পরিবর্তন হয়েছে যা স্বাভাবিক।

২. 
বিশ্ববিদ্যালয় এ ভর্তি হওয়ার পর আমার বাড়িতে আসা যাওয়া বেশ কমে গেলো, বাড়িতে গেলেও দু’এক দিনের বেশী থাকা হতো না। শম্পার সাথে কথাবার্তা একদম কমে গেলো। তাছাড়া তখন যোগাযোগেরও তেমন কোন মাধ্যমও ছিলো না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নতুন পরিবেশ, বলতে দ্বিধা নেই আমার মধ্যে এক ধরনের নতুনত্বের প্রভাব ফেলে দিয়েছিলো। ভুলে যেতে লাগলাম পুরোন অনেক কিছুই আর সেই সাথে শম্পার উপস্থিতিও ¤øান হতে শুরু করলো আমার কাছে।

জীবনের রং বদলাতে শুরু করলো চারিদিক থেকে, একটা অজানা আশংকা কাজ করতে শুরু করলো শম্পার মধ্যে। বন্ধুরা কেউ কেউ জানতো শম্পা আর আমার ভালো লাগার কথা কিন্তু ঐ পর্যন্তই, এ নিয়ে আর কেউ এগিয়েও আসে নাই। আমার পরিবারের দিক থেকে কেউ ওদের পরিবারকে তেমন পছন্দ করতো না সেটা শম্পা বুঝতো। তা সত্বেও আমার উপর প্রচন্ড ভরসা ছিলো শম্পার, ও জানতো আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার পরিবারের কেউ টিকে থাকতে পারবে না। বছর খানেক পরে একদিন শুনলাম ওর বিয়ে হয়ে গেছে। দিল্লীর কর্নাট প্লেসে রেডিমেড কাপড়ের বড় দোকান, স্বামী ব্যবসায়ী। পারিবারিকভাবেই ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান ওর স্বামী। কিন্তু পুরো বিষয়টার মধ্যেই যে একটা শঠতা কাজ করেছে সেটা ধীরে ধীরে সবার কাছে উন্মোচিত হয়ে গেলো। বিষয়টা একটা আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী দলের কারসাজী। ওরা বিষয়টা এত সুক্ষ্নভাবে সুসম্পন্ন করেছে যে কেউ জেনে উঠতেও পারে নাই সহজে। ফলাফল ছয় মাসের মাথায় পুরো চক্র পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সাত দিন জেল খেটে শম্পা বের হয়ে গেলেও আর দেশে ফিরে এলো না। শুনেছিলাম দিল্লীর কোথাও থাকে আর ওখানেই কোন চাকরী করে। আটলান্টিকের উপরে প্লেনে বসে জানালা দিয়ে নীচের তুলা মেঘের দিকে চিন্তা করলাম দৃষ্টিতে যা দেখা যায় তার পিছনে কত লম্বা সত্য লুকিয় থাকে তা কি খোলা চোখে দেখা সম্ভব? এই তুলা মেঘের নীচেই রয়েছে লক্ষ কোটী গ্যালন জলরাশি যা উপর থেকে বোঝা সম্ভব না। লম্বা পথের মোড়ে মোড়ে ঘটে হাজারো স্বপ্ন ভাংগা দীর্ঘশ্বাস, কত জনই বা সেটা জানে।

৩. 
দীর্ঘ বিরতির পর শম্পার সাথে দেখা হয়েছিলো আবার সেই হিথ্রো’র ডিপারচার লাউঞ্জে সম্ভবত বছর দশেক এর পর। থমকে গেলাম, মনে হলো কে যেন আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। তাকালাম সামনে দেখলাম, মনে হলো যেন ইউরোপীয়ান পোষাকে পুরোদস্তুর শীর্ষ কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের এক কর্পোরেট কর্মকর্তা। বল্লো, কেমন আছো? চিনেছো আমাকে? শান্ত কন্ঠে বল্লাম, চিনবো না কেন! ভালো আছো তো! কুশল বিনিময়ের পর কোটের পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ডের ফোল্ডার খুলে একটা ভিজিটিং কার্ডটা এগিয়ে দিলো আমার দিকে। বল্লো, একটা ব্যবসায়িক কাজে প্যারিস যাচ্ছি। এক ঘন্টার মধ্যে প্লেন ছেড়ে দেবে, হাতে সময় নাই। নেক্স স্যাটার ডে আমার নাম্বারে ফোন দিও, ঐ দিন ফ্রী থাকবো। কথা বলে আমরা নেক্সট মিটিং প্লেস ঠিক কর নেবো। ধরে ধীরে শম্পা চলে গেল আমার সামনে দিয়ে বিস্ময়ের এক আবহ সৃষ্টি করে, কোনো এক অজানা পথের সন্ধানে।

ইউসুফ কামাল : উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ